9 September 2024 , 11:32:36 প্রিন্ট সংস্করণ
সাল ১৯৭১। দেশকে পাক হানাদার বাহিনীরঁ কবল থেকে মুক্ত করতে দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে মেজর জিয়াউদ্দিন আহমেদ (অবসরপ্রাপ্ত) সাব সেক্টর কমান্ডার-৯ এর অধীনে পিরোজপুর গভর্মেন্ট হাইস্কুলের মাঠে যুদ্ধের প্রশিক্ষণে অংশ নেয় কালীকাঠী গ্রামের শাহজাহান নামের ১৯ বছরের টগবগে এক তরুণ। ঐ প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে আব্দুর রশীদ ও বরকত উল্লা সকল অংশগ্রহণকারীদের থ্রি নট থ্রি রাইফেল চালনাসহ যুদ্ধের বিভিন্ন কৌশল হাতে-কলমে শেখান। প্রশিক্ষণরত অবস্থায় শাহজাহানসহ ১৬ যোদ্ধাকে মেজর জিয়াউদ্দিনের নির্দেশে বাগেরহাটের নাগের বাজার মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে পাঠানো হয় এবং সেখানে নূরুল হক হাওলাদারের নেতৃত্বে সরাসরি বিভিন্ন যুদ্ধে সফলভাবে অংশ নেয় তারা।
এদিকে সৈনিক শাহজাহানের পিরোজপুরস্থ নিজ বাড়িতে বৈঠকখানা ও পার্শ্ববর্তী সরকারি প্রাথমিক স্কুলে মেজর জিয়াউদ্দিন মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প স্থাপন করেন। কিন্তু রাজাকার মারফত খবর পেয়ে পাক হানাদার বাহিনী শাহজাহানের বাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দেয় এবং মুক্তি বাহিনীকে সহযোগিতাকারীদের রাতের আধারে বাড়ি থেকে আটক করে নিয়ে যায়। এ সময় অন্যদের সাথে ধরা পড়ে যায় শাহজাহান। সবাইকে মেরে ফেলতে অন্যদের সাথে শাহজাহানের ওপরও গুলি চালায় পাক বাহিনী। ভাগ্যক্রমে গুলিবিদ্ধ শাহজাহান নদীর পানিতে ভেসে জানে বেঁচে যায়। মারাত্মক আহত শাহজাহান গোপনে পিরোজপুর সদর হাসপাতালে ভর্তি হয়ে তৎকালীন ডাক্তার মোশারফ হোসেন (এম.বি.বি.এস) এর শরণাপন্ন হন।
দীর্ঘদিন তার কাছে চিকিৎসা নিয়ে আস্তে আস্তে সুস্থতা লাভ করলেও আজও শরীরে (বাম বোগলের নিচে বুকের পাশে) বয়ে বেড়াচ্ছেন সেই গুলির ক্ষতচিহ্ন। পরবর্তীতে পাক হানাদার বাহিনীর কবল থেকে দেশকে মুক্ত করতে পারলেও আজও নিজের প্রাপ্ত স্বীকৃতি আদায় করতে পারেননি পিরোজপুরের সেই শাহজাহান। ঘটনাটি কোন গল্প নয়, বাস্তব ঘটনা। পিরোজপুরের কালিকাঠি গ্রামের মরহুম হাসেম তালুকদারের পুত্র সেই শাহজাহান তালুকদার মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিল। দাপটের সাথে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করায় সহযোদ্ধা ও কমান্ডারদের কাছ থেকে পেয়েছেন প্রশংসনীয় বিভিন্ন সনদ ও প্রত্যয়নপত্র, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রয়েছে সকল কাগজপত্র।
কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তার প্রাপ্য সম্মান ও স্বীকৃতিটুকু আজও অদৃশ্য কারণে পাননি। সরকারের বিভিন্ন মহলে যোগাযোগ করলেও উল্লেখযোগ্য সাড়া মেলেনি কোথাও, বরং দিনের পর দিন বিভিন্ন অজুহাতে বিভিন্ন দপ্তর তাকে ঘুরিয়েছে এক টেবিল থেকে অন্য টেবিল। সরেজমিনে খোজ নিয়ে দেখা যায়, তদানীন্তন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা সর্বাধিনায়ক আতাউল গনি ওসমানী পিরোজপুরের শাহজাহানকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সনদপত্র (যার নং-২৩৬৩৬৬) প্রদান করেছেন, যেখানে আঞ্চলিক অধিনায়ক হিসেবে মেজর মঞ্জুর স্বাক্ষরও রয়েছে। শাহজাহানকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর ৯নং সেক্টরের সাব সেক্টর কমান্ডার মেজর জিয়াউদ্দিন আহমেদ (অবসরপ্রাপ্ত) ছাড়াও প্রত্যয়ন পত্র দিয়েছেন পিরোজপুরের সদর উপজেলার বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের শংকরপাশা ইউনিয়ন কমান্ডের কমান্ডার মোঃ সুলতান আহমেদ।
এছাড়াও গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা মোঃ নুরুল ইসলাম তালুকদার (গেজেট নং-৩৭০, লাল বই নং- ০৬০৫০১০৩৪৭), আঃ কাদের হাওলাদার (গেজেট নং- ১৫৪, লাল বই নং- ০৬০৫০১০২৯৮), মোঃ সুলতান মাতুব্বর (গেজেট নং-৩৮০, লাল বই নং- ০৬০৫০১০৩৭৩) একই সাথে যুদ্ধে অংশ নেওয়ায় সহযোদ্ধা হিসেবে শাহজাহান তালুকদারকে প্রত্যয়ন পত্র দিয়েছেন। এমনকি কমান্ডার মোঃ সুলতান আহমেদ শাহজাহানের নাম মুক্তিযোদ্ধা গেজেটে অন্তর্ভুক্তির জন্য জোর সুপারিশ করেন। কিন্তু বিধিবাম, সক্রিয় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সকলের প্রশংসা, প্রত্যয়ন ও সনদ থাকা সত্ত্বেও আজও প্রাপ্য স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত রয়েছেন শাহজাহান।
এ বিষয়ে ভুক্তভোগী শাহজাহান তালুকদারের সাথে কথা বলে জানা যায়, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্তির জন্য মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল, বাংলাদেশ বরাবর আবেদন করলে খন্দকার নুরুল ইসলাম, প্রশাসনিক কর্মকর্তা বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল, ঢাকা বিষয়টি যথাযথ তদন্তের নির্দেশ দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি তালিকা পিরোজপুর মুক্তিযোদ্ধা সংসদে পাঠায়। উক্ত তালিকায় শাহজাহান তালুকদারের ক্রমিক নং ছিল ১৫৫। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যাচাই বাছাইকালীন সময়ে শাহজাহানকে কোন প্রকার পত্র বা চিঠি দিয়ে জ্ঞাত করা হয়নি এবং এ সময়ে সরকারি চাকুরীতে অন্য জেলায় কর্মরত থাকায় খবরটাও তিনি পান নাই।
তাই শাহাজান উপস্থিত না থাকায় তার নাম-ও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়নি। পরবর্তীতে একাধিকবার বিভিন্ন মহলে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও অদৃশ্য কারণে আজও ফাইলবন্দী হয়ে পড়ে রয়েছে শাহজাহানের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার প্রয়োজনীয় সনদগুলো। কর্তৃপক্ষের কাছে প্রশ্ন, মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে হারিয়েছেন নিজের বাড়ি ঘর, শত্রুপক্ষের গুলিতে ক্ষত আজও বয়ে বেড়াচ্ছেন নিজের শরীরে, যুদ্ধে অংশ নেওয়া সহযোদ্ধা থেকে শুরু করে কমান্ডার পর্যন্ত প্রত্যয়নপত্র ও সনদ দিলেও মিলছে না প্রকৃত স্বীকৃতি, তাহলে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নিজেকে প্রমাণের জন্য আর কি কি প্রয়োজন? অথচ দেশে ভুয়া সনদে হাজারো ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা দিব্যি বুক ফুলিয়ে নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিয়ে বেড়াচ্ছে। কর্তৃপক্ষ বিষয়টি আমলে নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলে আজও আশায় বুক বেধে আছেন পিরোজপুরের সেই শাহজাহান।