জাতীয়

সংবিধান সংশোধন কিংবা পুনর্লিখন ভবিষ্যতে স্বৈরতন্ত্র ঠেকানো কি আসলেই সম্ভব

গত পাঁচই আগস্ট সংগঠিত হয় ছাত্র-জনতার এক রক্তক্ষয়ী গণঅভ্যুত্থান, যা জুলাই বিপ্লব নামে পরিচিত। এই বিপ্লবের মাধ্যমে পতন ঘটে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলে রাখা স্বৈরাচার শেখ হাসিনার। এরপর ছাত্র-জনতার ম্যান্ডেট নিয়ে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তীকালীন। তবে এই সরকার গঠনের পর থেকেই ‘রাষ্ট্র সংস্কারের’ দাবি তুলেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সংগঠন ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। এমন অবস্থায় এই সংস্কার করতে সবার আগে সংবিধান সংশোধনের পরামর্শও দিচ্ছেন অনেকে।

আবার কেউ কেউ বলছেন, এই মুহূর্তে সংবিধান পুনর্লিখন ছাড়া রাষ্ট্র সংস্কার সম্ভব না। ‘রাষ্ট্র সংস্কারের’ প্রশ্নে তৈরি হচ্ছে নানা মত ও পথের। তবে এই প্রশ্নে বিশ্লেষকরা উদাহরণ হিসেবে টানছেন শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসন আমলকে। তারা বলছেন, বর্তমানে বাংলাদেশের সংবিধানে প্রধানমন্ত্রী বা সরকার প্রধানকে এমন কিছু ক্ষমতা দিয়েছে যার মাধ্যমে ওই পদে বসে যে কেউ স্বৈরাচারী হয়ে ওঠার সুযোগ পায়।

এক্ষেত্রে সংবিধান পুনর্লিখনে গণপরিষদ গঠনেরও পরামর্শ দিচ্ছেন বিশ্লেষকরা। সংবিধান পুনরায় লেখার জন্য যারা সবচেয়ে বেশি জোরদার দাবি ও যুক্তি তুলে ধরছেন তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন রাষ্ট্র বিজ্ঞানী ও যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আলী রীয়াজ। অধ্যাপক রীয়াজ বলছেন, এই গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা হলো, দেশকে স্বৈরশাসনমুক্ত করে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। জনগণের এই আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন করতে হলে সংবিধানের পুনর্লিখন করতে হবে।

তাহলে কি সংবিধানে পুনর্লিখন না করে সংশোধন বা রাষ্ট্রের আইনের সংস্কার করে এটি সম্ভব না? এমন প্রশ্নে কেউ কেউ উদাহরণ টানছেন ২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ের সংস্কারের কথা। অনেকে মনে করছেন, জোড়াতালি দিয়ে যদি সংবিধান সংশোধন বা আইনের সংস্কার’ করা হলে স্বৈরতন্ত্র রোধ করা সম্ভব না। তবে এর পাল্টা যুক্তিও আছে। অনেকে বলছেন, গত পাঁচই আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে, নতুন দেশ গঠিত হয়নি।

তাই সংবিধান পুনর্লিখনের কোন প্রয়োজন আছে বলে তারা মনে করেন না। সংবিধান বিশেষজ্ঞ শাহদীন মালিক বলেন, বৈষম্যহীন রাষ্ট্র গঠনে যা যা দরকার তা বর্তমান সংবিধানেই আছে। বিদ্যমান সংবিধান দিয়েই চাইলেই সংকটের সমাধান সম্ভব।

পুনর্লিখন বা সংশোধন কেন জরুরি?

১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন করা হলেও বিভিন্ন সময়ে তা সংশোধন করেছে রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দল ও কিংবা শাসকরা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০০৯ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় বসার পর গত সাড়ে ১৫ বছরে বিভিন্ন কায়দায় স্বৈরতান্ত্রিক হয়ে উঠেছিলেন। ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করতে ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হয় তার ইচ্ছাতেই।

রাষ্ট্র বিজ্ঞানী অধ্যাপক রীয়াজ বলেন, বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধানে ক্ষমতা এককেন্দ্রিক করার সুযোগ এমনভাবে করে দিয়েছে, ভবিষ্যতেও যে কোনো ব্যক্তির পক্ষে ব্যক্তিতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। আওয়ামী লীগ সরকারের গত ১৫ বছরেরও বেশি সময়ের কথা উল্লেখ করে তিনি বলছেন, শেখ হাসিনা তার শাসনামলে যে ক্ষমতা চর্চা করেছেন তা সংবিধান তাকে এক অর্থে দিয়েছে।

যে কারণে এমন একটা অভ্যুত্থানের পর সংবিধান পুনর্লিখন না করে শুধু সংস্কার করে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব না। তবে বিদ্যমান সংবিধানেও সংকটের সমাধান সম্ভব বলে মনে করছেন আইন বিশেষজ্ঞরা। সংবিধান বিশেষজ্ঞ শাহদীন মালিক বলছেন, বাংলাদেশের সংবিধানে ১৫৩টি অনুচ্ছেদ আছে। কোনটা সংস্কার করতে চায় কেন করতে চায় এই উত্তর কারও কাছে নেই।

যে ধারাগুলো আছে সেটাতে আসলে অসুবিধা কোথায় সেটা তো জানা প্রয়োজন। ‘রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন’ নামে একটি সংগঠনের প্রধান সমন্বায়ক ও সিনিয়র আইনজীবী হাসনাত কাইয়ুম বলেন, নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, স্থানীয় সরকার বিভাগসহ এমন বেশ কিছু জায়গায় পরিবর্তন যদি আনা যায় তাহলে এর মাধ্যমে ভবিষ্যতে স্বৈরতান্ত্রিক কাঠামো থেকে বের হয়ে আসা সম্ভব। তবে এটা সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমেই করা সম্ভব।

সাংবিধানিক ঝুঁকি কতখানি?

বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধানের ৭ (ক) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি শক্তি প্রদর্শন বা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বা অন্য কোনো অসাংবিধানিক পন্থায় এই সংবিধান বা এর কোনো অনুচ্ছেদ রদ, রহিত বা বাতিল বা স্থগিত করলে কিংবা সেটি করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করলে তার এই কাজ রাষ্ট্রদ্রোহিতা হবে এবং ওই ব্যক্তি রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে দোষী হবেন। এমন প্রশ্নে বিশ্লেষকরা বলছেন, গণঅভ্যুত্থানের পর যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন হয়েছে সেটিও সংবিধানের কোথাও নেই।

সুতরাং এমন অবস্থায় রাষ্ট্র সংস্কারের চাহিদা থেকে সংবিধান নতুন করে লেখার সুযোগ রয়েছে। তাতে কোনো সাংবিধানিক সংকটও তৈরি হবে না। এক্ষেত্রে অধ্যাপক রীয়াজের যুক্তি হচ্ছে, সংকট তৈরি হবে তখন যদি আগের সংবিধান বাতিল বা স্থগিত করা হয়। কিন্তু যদি আগের সংবিধান বহাল থাকা অবস্থায় সেই সংবিধানকে মূল ধরে নতুন করে সবার মতামতের ভিত্তিতে পুনর্লিখন করা হয় তাহলে এটি নিয়ে সংকট তৈরির কোন সুযোগ নেই।

আইনজীবী কাইয়ুম বলছেন, এই মুহূর্তে সংবিধান পুনর্লিখন বা সংশোধন করতে হলে সব রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি বা দেশের মানুষের ঐক্যমত্য দরকার। বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের মত যদি থাকে তাহলে প্রশ্ন উঠলেও পরবর্তী নিয়ে সংকট তৈরি হবে না।

সংবিধান ও গণপরিষদ

দেশের জনগণের পক্ষ থেকে সংবিধান রচনার দায়িত্ব যে সাংবিধানিক কমিটির মাধ্যমে সম্পাদিত হয় তাকে গণপরিষদ বলা হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ৭২ সালের গঠিত গণপরিষদ বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন করে। এক্ষেত্রে গত ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গণপরিষদের মত কোনো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে কী না তা নিয়ে দুই ধরনের বিশ্লেষণ পাওয়া যাচ্ছে।

আইনজীবী কাইয়ূম বলেন, যেহেতু ৫ আগস্ট বিপ্লবে দেশের সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ আছে এই গণপরিষদের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠার সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে এটির নাম সংস্কার গণপরিষদ করা যেতে পারে। অধ্যাপক রীয়াজ অবশ্য সংবিধান সংশোধন বা পুনর্লিখনে গণপরিষদ গঠনসহ তিনটি পদ্ধতিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন।

প্রথমত, গণপরিষদ বা সংবিধান সভা করা সংবিধান প্রণয়ন, দ্বিতীয়ত রাজনৈতিক দল বা সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে খসড়া সংবিধান প্রস্তুত করে গণভোট আয়োজন করা, তৃতীয়ত গণ শুনানির মাধ্যমে সংবিধান প্রস্তুত করা। সেক্ষেত্রে এই রাষ্ট্র বিজ্ঞানীর পরামর্শ হচ্ছে, যখন সবার মতামতের ভিত্তিতে নতুন সংবিধান চূড়ান্ত হবে তখন একটি নির্দিষ্ট তারিখে বিদ্যমান সংবিধান স্থগিত করে নতুন সংবিধান চালু করতে হবে।

বর্তমান সংবিধানে সংকট কোথায়?

গত ৮ আগস্ট দায়িত্ব অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেবার পরে তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করেছে। এসব বৈঠকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে রাষ্ট্র সংস্কারে বিভিন্ন ধরনের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। কোন কোন রাজনৈতিক দল এক্ষেত্রে সংবিধান সংশোধনের কথাও বলেছেন।

তবে বিশ্লেষকদের মধ্যে কেউ কেউ মনে করছেন বর্তমানে বাংলাদেশে যে সংকট রয়েছে সেটি বিদ্যমান সংবিধান ও আইনের মাধ্যমে সহজেই সমাধান করা সম্ভব। সংবিধান বিশেষজ্ঞ শাহদীন মালিক বলেন, এখন অনেকে সংস্কারের কথা বলে। কিন্তু আমার প্রশ্ন এই সংবিধানের যে ধারাগুলো আছে সেটাতে আসলে অসুবিধা কোথায় সেটা তো জানতে হবে।

যারা সংস্কারের কথা বলছে তারা কোনটা সংস্কার চায় সেটা স্পষ্ট করে বলেনি। তবে এই প্রশ্নে দ্বিমত আছে অধ্যাপক রীয়াজের। তিনি বলছেন, এই অভ্যুত্থানের অন্যতম উদ্দেশ্য ক্ষমতার অপব্যবহার রোধ করা। কিন্তু বর্তমান সংবিধান চালু রেখে যদি এতে সংস্কার করা হয় সেটি কখনোই টেকসই হবে না।

২০০৭ সালের ওয়ান ইলেভেনের সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়কার সংস্কারের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, যদি তখন যে সংস্কার করা হয়েছিল তা পরে আর কার্যকর থাকেনি। ফলে এই সংকট কাটাতে কিংবা প্রধানমন্ত্রীর এককেন্দ্রিক ক্ষমতা কমাতে সংবিধান পুনর্লিখনের কোনো বিকল্প নেই।

তবে আইনজীবী কিংবা বিশ্লেষকরা এটি মানছেন, ২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের পর ছাত্র জনতার যে রাষ্ট্র সংস্কারের চাহিদা তা পূরণ করতে হলে আগে সব ক্ষেত্রে সংস্কার এনেই তারপর আয়োজন করতে হবে সংসদ নির্বাচনের। তাদের ধারণা সেটি না হলে এই অভ্যুত্থানের পর নতুন করে আবারও স্বৈরতন্ত্রের পথে হাঁটতে পারে ভবিষ্যতের যে কোন রাজনৈতিক সরকার।