ধর্ম

ডায়াবেটিস রোগীরা হজের প্রস্তুতি নেবেন যেভাবে

হাইপারগ্লাইসেমিয়া বা রক্তে গ্লুকোজ বেড়ে যাওয়া হজ যাত্রীদের একটি সাধারণ সমস্যা। গবেষণায় দেখা গেছে, ২৭ শতাংশেরও বেশি হাজির রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বেশি ছিল। এ সময় খেজুর এবং ভাজা খাবারের মতো উচ্চ-ক্যালরিযুক্ত খাবার অত্যধিক খাওয়ার কারণে এ ধরনের জটিলতা হতে পারে। খেজুর, ভেড়ার মাংস, বাকলাভা, বাসবউসা, বাদাম ইত্যাদি ক্যালরিযুক্ত খাবার।

* কী কী সঙ্গে নেবেন

▶ রক্তের গ্লুকোজ মনিটরিং ডিভাইস বা গ্লুকোমিটার।

▶ ব্যান্ড এইডস বা কেটে ছিঁড়ে গেলে স্ট্রিপ এবং গ্লুকোমিটারের জন্য অতিরিক্ত ব্যাটারি। পর্যাপ্ত পরিমাণ ওষুধ।

▶ ইনসুলিন সংরক্ষণের উপযোগী ফ্লাস্ক বা ঠান্ডা ওয়ালেট।

▶ ডায়াবেটিস মেডিকেল রেকর্ডের একটি অনুলিপি, যা সর্বদা হজযাত্রীর সঙ্গে বহন করা প্রয়োজন।

▶ চিনিযুক্ত খাবার এবং পানীয়।

▶ মুখোশ বা মাস্ক, ছাতা, ভালো ফিটিং জুতা, সুতির মোজা এবং নন-সেন্টেড হ্যান্ড স্যানিটাইজার।

▶ হাইপোগ্লাইসেমিয়া প্রতিরোধে চিনি, মিষ্টি, ক্যালরিযুক্ত খাবার।

▶ তাপমাত্রার পরিবর্তনের বিষয়টি লক্ষ্য রেখে হজ যাত্রার আগে ডায়েটরি চার্ট বহন করা।

▶ রোদ-সুরক্ষার জন্য সানস্ক্রিন, ময়েশ্চরাইজার এবং পর্যাপ্ত হাইড্রেশন।

* হজের আগে সুস্বাস্থ্য পরিকল্পনা

ডায়াবেটিস রোগীদের চিকিৎসকের দ্বারা ক্লিনিক্যাল মূল্যায়ন করা উচিত। যার মধ্যে পা পরীক্ষা, কিডনি এবং কার্ডিওভাসকুলার বা হার্টের প্রোফাইল এখনই করে নেওয়া উচিত। হজযাত্রার আগে রোগীর রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা, আহারের আগে এবং পোস্ট-প্রান্ডিয়াল বা খাওয়ার পর গ্লুকোজের মাত্রাসহ এবং গ্লাইকেটেড হিমোগ্লোবিন ইত্যাদি অবশ্যই পর্যবেক্ষণ করা উচিত। দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগে আক্রান্ত রোগীদের ডিহাইড্রেশন বা পানিস্বল্পতা রোধ করতে হবে। প্রয়োজনে শিরায় তরল পরিচালনা করা যেতে পারে। যাত্রা শুরু করার আগে রক্তচাপ এবং রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা উভয়ই নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং তা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।

* হাইপোগ্লাইসেমিয়া

শারীরিক কার্যকলাপ বেড়ে যাওয়া এবং হজকালীন খাবারের নিয়ম মেনে না চলতে পারার কারণে, ডায়াবেটিসের সব রোগী এ সময় হাইপোগ্লাইসেমিয়ার উচ্চ ঝুঁকিতে থাকেন। ১৪.৯ এবং ১২.৫ শতাংশ ডায়াবেটিক রোগীর যথাক্রমে ক্লান্তি এবং মাথাব্যথার জন্য হাইপো দায়ী। এ রোগীরা প্রায়ই হাইপোগ্লাইসেমিয়ার লক্ষণগুলোকে অবহেলা করে হজের কার্যক্রম চালাতে চান। যা বিপজ্জনক।

* হাইপোগ্লাইসেমিয়ার ঝুঁকি কীভাবে কমাবেন

মুখে খাবার ডায়াবেটিসের ওষুধ, যেমন সালফোনাইলুরিয়াস, হাইপোগ্লাইসেমিয়ার উচ্চ ঝুঁকির সঙ্গে যুক্ত। হজ যাত্রার সময় প্রয়োজন হলে রোগীর জন্য এ ওষুধের ডোজ কমানোর পরামর্শ দেওয়া যেতে পারে। ইনসুলিন গ্রহীতা রোগীরা হাইপোগ্লাইসেমিয়ার উচ্চ ঝুঁকিতে থাকেন, তাই রোগীর গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণের মাত্রার ওপর নির্ভর করে চিকিৎসকের পরামর্শ ইনসুলিনের ডোজ হ্রাস করে এ ঝুঁকি এড়ানো যেতে পারে।

* পায়ের জটিলতা

হাজিদের অনেকের পায়ের জটিলতা যেমন-ক্ষত বা ঘা হওয়ার ঝুঁকি থাকে। ডায়াবেটিস রোগীর পায়ের আলসার বা ঘা হলে অনেকক্ষেত্রে অস্ত্রোপচারের দরকার হয়। হাঁটতে গিয়ে অনেক হজযাত্রীর পায়ে ফোসকা পড়ে যায়, রোগীর পা ফুলে যায়। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের রোগীদের পায়ে সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি থাকে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া, ক্ষত নিরাময়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া এবং নিউরোপ্যাথি এবং পেরিফেরাল ভাস্কুলার রোগের উপস্থিতির কারণে ডায়াবেটিস রোগীরা পায়ের জটিলতার সম্মুখীন হন। গ্রীষ্মের মাসগুলোতে মাটির উচ্চ তাপমাত্রার (প্রায় ৬০ সেন্টিগ্রেড) কারণে পা পুড়ে যাওয়ার একটি উল্লেখযোগ্য ঝুঁকি, যা থেকে পরে পায়ের আলসারের কারণ হয়।

* হজের সময় পায়ের যত্নে করণীয়

▶ প্রতি দিন দু’বার ভালো মানের অ-গন্ধযুক্ত ময়েশ্চারাইজার পায়ে ব্যবহার করা উচিত।

▶ দৈনিক নিজের পা নিজে পরীক্ষা করা আবশ্যক এবং গরম পানিতে পা ডুবানো অবশ্যই এড়িয়ে চলতে হবে।

▶ এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাতায়াতের জন্য, যা ৫ থেকে ১৫ কিলোমিটারের মধ্যে হলে, মোটরচালিত যান বা হুইল চেয়ারে চলাচল করা নিরাপদ।

▶ মসজিদের মধ্যে প্যাডেড মোজা ব্যবহার করা আবশ্যক; খালি পায়ে হাঁটা উচিত নয়।

▶ হাঁটাহাঁটির সময় হালকা ওজনের, পায়ের গোড়ালি এবং বলের প্যাডিংসহ নরম প্যাডেড জুতা ব্যবহার করা উচিত।

▶ পা শুকনো রাখা উচিত এবং ওজু করার পর সুতির তোয়ালে দিয়ে পা মুছে নিতে হবে।

▶ প্রদাহ এবং সংক্রমণ দেখা দিলে টিস্যু ক্ষতির ঝুঁকি কমাতে প্রফাইল্যাকটিক অ্যান্টিবায়োটিক শুরু করার উচিত।

▶ পায়ে ফোসকা দেখা দিলে, পা শুষ্ক রাখা উচিত।

▶ হজযাত্রীদের শারীরিক কার্যকলাপ বেড়ে যাওয়ার কারণে কার্ডিওভাসকুলার ইভেন্টগুলো ট্রিগার হতে পারে।

* চোখের রোগ প্রতিরোধে করণীয়

হজযাত্রীদের মধ্যে অনেকেই ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথিতে আক্রান্ত। চোখের রোগে আক্রান্ত রোগীদের হজের আচার-অনুষ্ঠান সম্পাদনের সময় পতন বা পড়ে যাওয়া রোধ করার জন্য সঠিক নিয়মে হাঁটতে হবে। সব রোগীকে অবশ্যই তাদের চোখ হাত দিয়ে স্পর্শ এড়িয়ে চলা উচিত। সমস্যা কাটাতে চোখের লুব্রিকেন্ট ড্রপ ব্যবহার করা যায়।

* শিক্ষামূলক ব্যবস্থা

রোগীদের অবশ্যই রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা এবং প্রস্রাবে কিটোন বডি নির্ধারণের জন্য গ্লুকোমিটার এবং ডিপস্টিক ব্যবহার সম্পর্কে শিক্ষা দিতে হবে। ইহরামের আগে রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে, ইনসুলিনের ডোজ সমন্বয় করা আবশ্যক। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য ইনসুলিনের ডোজ ১০-২০ শতাংশ বা সামান্য কমানোর পরামর্শ দেওয়া যেতে পারে।

* খাদ্য ব্যবস্থাপনা

নিয়মিত খাবারের পাশাপাশি খাবারের মধ্যবর্তী স্ন্যাকস খেতে হবে। অনিয়মিত খাবারের ক্ষেত্রে রোগীরা বাদাম, ফল এবং দুগ্ধজাত দ্রব্য গ্রহণ করতে পারেন। তাওয়াফের আগে প্রয়োজনে জটিল কার্বোহাইড্রেট এবং খেজুর খাওয়া যেতে পারে। হজ যাত্রার সময় কঠোরভাবে গ্লাইসেমিক নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা উচিত নয়, কারণ এ সময় হাইপোগ্লাইসেমিয়াই গুরুতর স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করে।

* ওষুধের সমন্বয়

টাইপ-১ ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে বেসাল-বোলাস ইনসুলিন (এনালগ) সবচেয়ে ভালো। রোগীদের অবশ্যই ইনজেকশনযোগ্য ইনসুলিন সঙ্গে নিয়ে যাওয়া উচিৎ, যাতে পাম্প কোনো কারণে অকার্যকর হয়ে গেলে বেসাল বোলাস পদ্ধতিতে সুইচ করা সহজতর হয়।

* অসুস্থ দিবসের নির্দেশিকা

রোগীরা অবশ্যই ইনসুলিন এবং অন্যান্য ওষুধ নিতে ভুলবেন না। রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা ঘন ঘন নিরীক্ষণ করতে হবে। যদি এ মাত্রাগুলো ১৫ মিলিমোল/লিটারের উপরে ওঠে, তবে প্রস্রাবের কিটোনগুলোর জন্য পরীক্ষা করা দরকার, যা প্রস্রাবের ডিপস্টিকের সাহায্যে করা যেতে পারে। যে কোনো ধরনের অসুস্থতা, সংক্রমণ, ডায়রিয়ার ক্ষেত্রে, হাইড্রেটেড থাকা, প্রচুর পরিমাণে অ-মিষ্টি পানীয় খাওয়া এবং অল্প করে ঘন ঘন খাবার খাওয়া অপরিহার্য। ক্ষুধা হ্রাস/অস্বস্তির ক্ষেত্রে ঘন ঘন স্ন্যাকিং এবং কার্বোহাইড্রেটযুক্ত পানীয় দিয়ে খাবার গ্রহণ করা উচিত।

%d bloggers like this: