জাতীয়

বাসের ভাড়া ৮০ পয়সা বাড়িয়ে ৮ পয়সা কমানো কতটা যৌক্তিক

ডি‌জে‌লের দাম দুই দফায় লিটা‌রে ৩ টাকা কমায় বাস ভাড়া কি‌লো‌মিটা‌রে ৩ পয়সা কমেছে। গতকাল সোমবার এ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ। ডিজেলের দাম লিটারে দুই দফায় ৪৯ টাকা বৃদ্ধি পাওয়ায় ২০২১ সালের নভেম্বর থেকে পরের বছর আগস্ট পর্যন্ত বাসের ভাড়া ৮০ পয়সা পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। গত দেড় বছরে তা কমেছে ৮ পয়সা।

সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) তথ্যানুযায়ী, ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের দূরত্ব ২৪২ কিলোমিটার। ৩ পয়সা কমায় ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে ৪০ আসনের বাসে ভাড়া কমবে ১০ টাকা। কক্সবাজার থেকে পঞ্চগড়ের দূরত্ব ৮৩১ কিলোমিটার। এ রুটে সর্বোচ্চ ৩৩ টাকা ভাড়া কমবে। ঢাকা-খুলনা ও ঢাকা-বরিশাল রুটে ৭ টাকা, ঢাকা-রাজশাহী ও ঢাকা-সিলেট রুটে ১০ টাকা, ঢাকা-রংপুর রুটে ১২ টাকা এবং ঢাকা-ময়মনসিংহ রুটে ৫ টাকা ভাড়া কমবে ৪০ আসনের দূরপাল্লার বাসে।

মঙ্গলবার থেকে হ্রাসকৃত বাস ভাড়া কার্যকর হবে জানিয়ে প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ৫২ আসনের দূরপাল্লার বাসে প্রতি কিলোমিটারের ভাড়া ২ টাকা ১৫ পয়সা থেকে কমে ২ টাকা ১২ পয়সা হবে। ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীতে অভ্যন্তরীণ রুটের ৫২ আসনের বাসের ভাড়া ২ টাকা ৪৫ পয়সা থেকে কমে হবে ২ টাকা ৪২ পয়সা। এই দুই শহরের লোকাল বাসে আগের মতোই সর্বনিম্ন ভাড়া থাকবে ১০ টাকা। মিনিবাসে কিলোমিটারে ভাড়া হবে ২ টাকা ৩২ পয়সা। মিনিবাসে সর্বনিম্ন ভাড়া হবে ৮ টাকা।

গতকাল দুপুরে রাজধানীর বনানীতে বিআরটিএ সদর কার্যালয়ে ভাড়া নির্ধা‌রণ ক‌মি‌টির সভা হয়। সভা থেকে কিলোমিটারে ৩ পয়সা বাস ভাড়া কমাতে সড়ক পরিবহন বিভাগে প্রস্তাব পাঠানো হয়।সভায় বাস মালিকরা ঈদের আগে ভাড়া না কমানোর দাবি জানিয়ে বলেন, এতে বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে। সরকারি অফিস বন্ধ থাকায় ভাড়া কার্যকর হচ্ছে কিনা, তা তদারকি করা যাবে না।

এদিকে ২০২১ সালের নভেম্বরে ডিজেলের দাম ৬৫ থেকে বাড়িয়ে ৮০ টাকা লিটার নির্ধারণ করে সরকার। সে সময়ে দূরপাল্লার বাসের ভাড়া ১ টাকা ৪২ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১ টাকা ৮০ পয়সা করা হয়। ঢাকা এবং চট্টগ্রামের লোকাল বাসের ভাড়া নির্ধারণ করা হয় ২ টাকা ১৫ পয়সা।

২০২২ সালের আগস্টে ডিজেলের দাম লিটারে ৩৪ টাকা বৃদ্ধি করা হয়। সেই সময়ে দূরপাল্লার ভাড়া বৃদ্ধি পেয়ে হয় ২ টাকা ২০ পয়সা। ঢাকা এবং চট্টগ্রামের লোকাল বাসের ভাড়া নির্ধারণ করা হয় ২ টাকা ৫০ পয়সা। ওই মাসেই ডিজেলের দাম ৫ টাকা বৃদ্ধি পেলে ভাড়া ৫ পয়সা কমানো হয়। এবার কমলো ৩ পয়সা। অভিযোগ রয়েছে, ভাড়া বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত সঙ্গে সঙ্গে কার্যকর হলেও কমানোর সিদ্ধান্ত মানেন না মালিকরা।

ভাড়া নির্ধারণ কমিটির সভায় বিআরটিএ চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার বলেন, ডিজেলের দাম আরও কমলে ভাড়াও কমবে। সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি মসিউর রহমান রাঙ্গা বলেন, ভারতে তেলের দামের সঙ্গে ভাড়া কীভাবে সমন্বয় করা হয়, তা দেখা দরকার। যাতে সভা না করেও তেলের দাম পরিবর্তনের সঙ্গে ভাড়াও পরিবর্তিত হয়। শুধু ডিজেল বিবেচনায় নিলে হবে না। যেমন– চাঁদা বেড়েছে, এ জন্য মালিকরা বলতে পারবেন না, ভাড়া বাড়াতে হবে।

বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান রমেশ চন্দ্র ঘোষ বলেন, ভাড়া নির্ধারণের অনেক খাত রয়েছে। ডিজেলই একমাত্র উপাদান নয়। টায়ারের দাম ৪৫ শতাংশ বেড়েছে।

বিআরটিএর পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ারিং) এবং ভাড়া নির্ধারণ কমিটির আহ্বায়ক শীতাংশু শেখর বিশ্বাস বলেন, টায়ারের হিসাব ধরেই ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে। ১০-২০ সাইজের টায়ার এখন ৩৪ হাজার ৫০০ থেকে ৩৬ হাজার ৫০০ টাকা। বাংলাদেশ পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী বলেন, তেলের দাম যখন ৩৪ টাকা বেড়েছিল, তখন কিন্তু ভাড়া সেভাবে বৃদ্ধি করা হয়নি।

কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট হুমায়ুন কবির বলেন, ভাড়া ৫ পয়সা কমানো উচিত। ৩ পয়সা তেমন প্রভাব ফেলবে না।

মূলত ভাড়া নির্ধারিত হয় বাসে ৫২ আসন ধরে। কিন্তু দূরপাল্লায় ৫২ আসনের বাস নেই। সর্বোচ্চ ৪০ আসনের বাস চলে। আসন কমলে আনুপাতিক হারে ভাড়া বাড়ে। যেমন ৫২ আসনের বাসে কিলোমিটারে ভাড়া ২ টাকা ১২ পয়সা নির্ধারণ করা হলেও ৪০ আসনের বাসে তা হবে ২ টাকা ৭৬ পয়সা। আগে যা ছিল ২ টাকা ৮০ পয়সা। ৪০ আসনের বাসে ভাড়া ৪ পয়সা কমায় ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের ভাড়া ৯ টাকা ৬৮ পয়সা তথা ১০ টাকা কমবে।

সরকার নন-এসি বাসের ভাড়া নির্ধারণ করে। এসি বাসের ভাড়া মালিকরা নিজেরা ঠিক করবেন। বাসে আসন যত কমে, ভাড়া তত বাড়ে।

ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরের বাসে ১৬ এবং দূরপাল্লার বাসে ১২ রকমের ব্যয় ধরে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়। নগর পরিবহনের বাসে ৯৫ শতাংশ এবং দূরপাল্লায় ৭০ শতাংশ যাত্রী পূর্ণ ধরে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়। ভাড়া নির্ধারণ কমিটির ব্যয় বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ঢাকা শহরের লোকাল বাসের রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতে বছরে বার্ষিক খরচ হয় সোয়া ১০ লাখ টাকা। প্রতি তিন মাস অন্তর ২৬ হাজার টাকার টায়ার লাগানো হয়। বছরে টায়ার-টিউবের খরচ ৩ লাখ ১২

হাজার টাকা। ইঞ্জিন ওভারহোলিংয়ে লাগে ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা। রেনোভেশনে লাগে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা। চালক শ্রমিকদের মজুরি বছরে পৌনে ৭ লাখ টাকা। বাস্তবতার সঙ্গে এসব ব্যয়ের মিল নেই। যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বিবৃতিতে বলেছেন, ৩ পয়সা ভাড়া কমানো তামাশা ছাড়া কিছুই নয়।