বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

এবার শীঘ্রই কসমিক রেলওয়ে দেখতে পাবে বিশ্ব

১৯৬০ সালে রুশ প্রকৌশলী ইয়ুরি আর্টসুটানভ স্পেস এলিভেটরের ধারণা দিয়েছেন। এটাকে তিনি বলেছেন ‘কসমিক রেলওয়ে’ বা মহাজাগতিক রেল-যোগাযোগব্যবস্থা। তাঁর হিসেবে, পৃথিবীর কক্ষপথে ঘূর্ণমান একটি কৃত্রিম উপগ্রহের সঙ্গে দড়ির মতো কিছুর একপ্রান্ত যুক্ত থাকবে, যেটার অন্য প্রান্তটি যুক্ত থাকবে বিষুবরেখার এখানে কোথাও। এই দড়ি দিয়ে বিভিন্ন জিনিস পাঠানো যাবে মহাকাশে। এই ধারণা নিয়ে আরও কাজ হয়েছে। বিখ্যাত মার্কিন কল্পবিজ্ঞান লেখক আর্থার সি ক্লার্ক এ নিয়ে কংগ্রেসের সামনে বক্তব্য রেখেছেন।

নাসা এবং যুক্তরাষ্ট্রের এয়ারফোর্স রিসার্চ ল্যাবরেটরির কাজের অভিজ্ঞতা থেকে এর ধারণাগত নকশা তৈরি করেছেন প্রকৌশলী জেরোম পিয়ারসন, ১৯৭৫ সালে। তিনি অবশ্য একে বলেছেন ‘অরবিটাল টাওয়ার’। এ জন্য তিনি চাঁদের মহাকর্ষ, বায়ু, গতিশীল ‘পেলোড’ বা ভারসহ আরও নানা বিষয় মাথায় রেখেছেন। তবে বহু গবেষণা, পরিকল্পনা শেষে আজও স্পেস এলিভেটর কল্পবিজ্ঞানের বিষয় হয়েই রয়েছে, বাস্তব হয়নি। শুরুর সেই প্রশ্নটায় আবার ফিরে এলাম আমরা—কেন? আসলে, অত বড় বা লম্বা কিছু নির্মাণের সবচেয়ে বড় সমস্যাটা হলো পৃথিবীর মহাকর্ষ।

আজ পর্যন্ত এমন কোনো পদার্থের খোঁজ পাওয়া যায়নি, যেটা দিয়ে এত লম্বা কিছু বানালে তা নিজের ভারে মুখ থুবড়ে বা ভেঙে পড়বে না। এই মহাকর্ষের কারণেই পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্টের উচ্চতা ২৯ হাজার ৩৫ ফিট। এর চেয়ে বড় হলে নিজের ভারেই সেটা ভেঙে পড়ে। সে সমস্যা এড়াতে দড়ির মতো কিছুর কথা ভাবা, যে কথা আগেই বলেছি। ভাবনাটা এখন পর্যন্ত ওরকমই—পৃথিবীর কক্ষপথে একটা কৃত্রিম উপগ্রহ ঘূর্ণমান থাকবে। এই উপগ্রহে যুক্ত থাকবে দড়ির একটা মাথা। অন্য মাথাটা যুক্ত থাকবে পৃথিবীর বিষুব অঞ্চলে।

উপগ্রহটা থাকতে হবে ভূস্থির কক্ষপথ থেকে অনেকটা ওপরে। ফলে দড়িটার ভরকেন্দ্র থাকবে ভূস্থির কক্ষপথের ওপরে। ভূস্থির কক্ষপথ মানে, পৃথিবীর নিজ কক্ষপথে ঘোরার হার আর এ কক্ষপথে ঘূর্ণমান উপগ্রহের বেগ একসমান হয়। ফলে পৃথিবীর সাপেক্ষে ওই কক্ষপথের উপগ্রহটা একই জায়গায় থাকে। ভূপৃষ্ঠ থেকে ৩৫ হাজার ৭৮৬ কিলোমিটার ওপরে রয়েছে এই ভূস্থির কক্ষপথ। এ কক্ষপথে বর্তমানে অনেক স্যাটেলাইট বা কৃত্রিম উপগ্রহ ঘুরছে—এর কোনোটা জিপিএস স্যাটেলাইট, কোনোটা টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থায় ভূমিকা রাখছে ইত্যাদি।

যাহোক, দড়ির ভরকেন্দ্র এই কক্ষপথের ওপরে থাকলে যথেষ্ট পরিমাণ ঊর্ধ্বমুখী সেন্ট্রিফিউগাল ফোর্স বা কেন্দ্রবিমুখী বল তৈরি হবে, যা নিম্নমুখী পৃথিবীর মহাকর্ষের সঙ্গে একটা ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থা তৈরি করবে। ফলে দড়িটা টানটান থাকবে। এই দড়ি—ইংরেজিতে যাকে বলে কেবল বা টেদার—হতে হবে অত্যন্ত চিকন, কিন্তু প্রচণ্ড শক্ত। ভারী কোনো ভার যেন এতে করে ওঠানো যায় যান্ত্রিকভাবে। পাশাপাশি, এটা যেন ছিঁড়ে না যায়। বর্তমানে, গ্রাফিন ও কার্বন ন্যানোটিউব দিয়ে এ ধরনের দড়ি বানানো যাবে বলে ধারণা করছেন বিজ্ঞানীরা।

তাত্ত্বিকভাবে সেটা সম্ভব হতে পারে, তবে সে জন্য এত বেশি কার্বন দরকার যে সেটা হয়ে উঠবে পরবর্তী বড় সমস্যা। স্পেস এলিভেটরকে সম্ভব করে তোলার জন্য বহু আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা আয়োজিত হয়েছে। সম্প্রতি এরকম এক প্রতিযোগিতায় প্যারিসের জ্যাকোয়া রোগারি ফাউন্ডেশন ব্রিটিশ স্থপতি জর্ডান উইলিয়াম হিউকে ১১ হাজার ডলারের পুরস্কার দিয়েছে বলে জানা যাচ্ছে বিবিসির এক রিপোর্টে। কিন্তু সেই রিপোর্টেই জানা যাচ্ছে, তাঁর এটাও কেবলই ধারণাগত নকশা। অতি সম্প্রতি স্পেস এলিভেটর সংশ্লিষ্ট সব সমস্যা কাটিয়ে উঠে আদৌ অমন কিছু নির্মাণ করা সম্ভব বলে ভাবছে না কেউই।