7 October 2023 , 2:14:05 প্রিন্ট সংস্করণ
অনুমোদনের কৌশল হিসেবে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে ছোট ছোট প্রকল্প। বিশেষ করে ৫০ কোটি টাকার নিচে ব্যয়ের এমন প্রকল্পে উৎসাহ দেখাচ্ছে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো। এর ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি পরিকল্পনা কমিশনে ছোট প্রকল্প প্রস্তাব বেশি আসছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে এসব প্রকল্প অনুমোদনেও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
পরিকল্পনা কমিশনে আসা প্রকল্প প্রস্তাব পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, প্রস্তাবিত প্রকল্পের অধিকাংশই ছোট। এসব প্রকল্পে বেশিরভাগই গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নবিষয়ক। গ্রামীণ সড়ক অবকাঠামো উন্নয়ন, স্যানিটেশন ব্যবস্থার উন্নয়ন, সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন, স্টেডিয়াম, মসজিদ, মাদ্রাসা, বিদ্যালয় নির্মাণ ও স্থাপন এসব প্রকল্পের আওতায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ছোট প্রকল্প পরিকল্পনামন্ত্রীর অনুমোদন এখতিয়ার থাকায় ঝক্কি কম থাকে। সেই সঙ্গে ছোট প্রকল্পের মাধ্যমে সংসদ নির্বাচনে স্থানীয় সংসদ সদস্যদের দৃশ্যমান কার্যক্রম দেখানো সম্ভব হয়। এ কারণে নির্বাচন সামনে রেখে বর্তমানে ছোট প্রকল্প অগ্রাধিকার পাচ্ছে বেশি।প্রকল্পগুলো পর্যালোচনা করে এবং কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দ্রুত অনুমোদনের জন্য কৌশল হিসেবে ছোট প্রকল্পগুলো নেওয়া হচ্ছে। এজন্য এসব প্রকল্পের ব্যয় এমনভাবে ধরা হচ্ছে, যেন ৫০ কোটির নিচে থাকে। ৪৯ কোটি ৯৯ লাখ টাকা ব্যয়ের প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে কোনোভাবেই ৫০ কোটির ওপরে যাচ্ছে না সংস্থাগুলো।
পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, সাধারণত বড় প্রকল্পগুলো একনেক সভায় অনুমোদন দেওয়া হয়। এজন্য প্রকল্পগুলো বিভিন্ন স্তরে অনেক যাচাই-বাছাই শেষে একনেক সভায় অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হয়। কিন্তু ৫০ কোটি টাকার প্রকল্পগুলো পরিকল্পনামন্ত্রী অনুমোদন দিতে পারেন, অনুমোদনের ঝক্কি-ঝামেলাও কম। এ কারণে মন্ত্রণালয় এবং বিভাগগুলো ছোট ছোট প্রকল্প প্রস্তাব করে থাকে, যাতে দ্রুত অনুমোদন নিতে পারে।
এদিকে সম্প্রতি এমপি, মন্ত্রী এবং বিভিন্ন এলাকার জনপ্রতিনিধির পরিকল্পনা কমিশনে যাতায়াত বেড়েছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী এমনকি কমিশনের সচিবসহ বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তাদের দপ্তরে ভিড় করছেন তারা। জানা গেছে, আসন্ন নির্বাচন এবং সরকারের শেষ সময় হওয়ায় ভোটারদের সন্তুষ্টির জন্য তারা প্রস্তাবিত প্রকল্পগুলো অনুমোদন করিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন।
পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান কালবেলাকে বলেন, নির্বাচনের জন্য আসছে কি না, সেটা বলতে পারব না। নির্বাচনের জন্য হলেও হতে পারে। এটি লুকানোর কিছু নয়। ছোট প্রকল্প সাধারণত গ্রামে হয়, নিম্নআয়ের মানুষের উপকারে কাজে লাগে। নির্বাচনের জন্য হলেও সমস্যা নেই। বাছাইটা যদি ঠিকঠাক মতো হয়, তাহলে ছোট প্রকল্পে লাভ বেশি। কারণ, ছোট প্রকল্পের মাধ্যমে সাধারণ গ্রামাঞ্চলে কাজ হয়। মনিটরিং ভালো হয়, চোখে দেখা যায় এবং দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহারে বাস্তবায়ন সম্ভব হয়। গ্রামের রাস্তাঘাট উন্নয়ন, খেলার মাঠ, মসজিদ নির্মাণ ও সংস্কারের মতো এমন ছোট প্রকল্প ভেরি গুড। শুধু বাছাইটা ঠিকঠাক মতো হতে হবে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর কালবেলাকে বলেন, নির্বাচনের জন্য সরকার বর্তমানে ছোট প্রকল্পে বেশি অর্থায়ন করছে, যেগুলো এমপিরা বাস্তবায়ন করেন। নির্বাচনের আগে এমনই হবে। তিনি বলেন, ছোট প্রকল্প নেওয়া তো একটা কৌশলই। কারণ, ৫০ কোটির নিচের প্রকল্প নিলে একনেকে ওঠানো লাগে না, পরিকল্পনামন্ত্রী এগুলো অনুমোদন দিতে পারেন। নির্বাচনের আগে দ্রুত অনুমোদন করিয়ে নিয়ে তাড়াতাড়ি খরচ করা যায়। অন্য সময় অর্থছাড় হতে দেরি হলেও এখন হবে না। কারণ, নির্বাচনের আগে তো অর্থছাড় করতে হবে এবং এসব কাজে ব্যয় করতে হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সর্বশেষ একনেক সভায়ও সাতটি প্রকল্প অনুমোদনের তথ্য একনেককে অবহিত করেছেন পরিকল্পনামন্ত্রী। চলতি অর্থবছর ৪ একনেকে প্রায় ৩০টির মতো অনুমোদনের তথ্য জানানো হয়েছে। এ ছাড়া আরও কিছু প্রকল্প অনুমোদনের জন্য প্রক্রিয়াধীন। যেগুলো একনেক সভায় উপস্থাপন করা হবে। পাশাপাশি পরিকল্পনা কমিশনে বেশ কয়েকটি ছোট প্রকল্প প্রস্তাবনা রয়েছে।
সম্প্রতি মাদারীপুর জেলার শিবচর উপজেলায় ইনডোর স্টেডিয়াম, সুইমিংপুল ও টেনিস কোর্ট নির্মাণের জন্য একটি প্রকল্প প্রস্তাব করেছে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়। এই প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৮ কোটি ৯০ লাখ টাকা। প্রকল্প প্রস্তাবের পিইসি সভায় পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা বলেন, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের যদি উপজেলা পর্যায়ে এ ধরনের ক্রীড়া কমপ্লেক্স নির্মাণের পরিকল্পনা থাকে, তাহলে ছোট ছোট প্রকল্প না নিয়ে সমন্বিত আকারে প্রকল্প নেওয়া উচিত।
গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ৫১ নম্বর ওয়ার্ডের অবকাঠামো উন্নয়ন শীর্ষক একটি প্রকল্প প্রস্তাব করেছে গাজীপুর সিটি করপোরেশন। খরচ ধরা হয়েছে ৪৯ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। চলতি অর্থবছরই ২৭ কোটি ৪২ লাখ টাকা চায় সংস্থাটি। নগর উন্নয়ন অধিদপ্তর শরীয়তপুর জেলার ছয়টি উপজেলায় সমন্বিত পরিকল্পনা প্রণয়ন শীর্ষক একটি প্রকল্প প্রস্তাব পাঠিয়েছে পরিকল্পনা কমিশনে। ব্যয় ধরা হয়েছে ২৩ কোটি ৯৫ লাখ টাকা।
নোয়াখালী সরকারি কলেজ অবকাঠামো উন্নয়ন শীর্ষক একটি প্রকল্প প্রস্তাব পাঠিয়েছে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর। ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৯ কোটি ৯৮ লাখ ৩৭ হাজার টাকা। অক্টোবর থেকেই কাজ শুরু করতে চায় সংস্থাটি। সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যমান একাডেমিক ল্যাবরেটরিগুলোর উন্নয়নে প্রকল্প প্রস্তাব এসেছে পরিকল্পনা কমিশনে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে খরচ ধরা হয়েছে ৪৬ কোটি ৪০ লাখ টাকা।
যশোর জেলায় রয়েছে তিনটি ছোট প্রকল্প প্রস্তাব। জেলার মনিরামপুর উপজেলার নিরাপদ পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন ব্যবস্থার সম্প্রসারণ এবং উন্নয়নে ২৯ কোটি টাকার একটি প্রকল্প প্রস্তাব পাঠিয়েছে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর। ভবদাহ ও তৎসংলগ্ন বিল এলাকায় জলাবদ্ধতা দ্রুত নিরসন শীর্ষক একটি প্রকল্প প্রস্তাব করেছে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড। এজন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৯ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। শার্শা উপজেলায় মানব পাচারের শিকার ব্যক্তিদের শারীরিক ও মানসিক সেবা দিতে ট্রানজিট শেল্টার হোম স্থাপনের জন্য ২৬ কোটি ৫৫ লাখ টাকা ব্যয়ের একটি প্রকল্প প্রস্তাব পাঠিয়েছে সমাজসেবা অধিদপ্তর।
কুড়িগ্রাম জেলার রৌমারী পিটিআই স্থাপন শীর্ষক একটি প্রকল্প প্রস্তাব করেছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। পিটিআই স্থাপনে খরচ ধরা হয়েছে ৪৬ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। যেটি প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রীর এলাকা বলে জানা গেছে।
বরগুনা জেলা স্টেডিয়ামের অধিকতর উন্নয়নসহ ডরমিটরি ভবন ও ইনডোর স্টেডিয়াম নির্মাণ করতে চায় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ। এজন্য ৪৯ কোটি ৫৯ লাখ টাকা ব্যয়ের একটি প্রকল্প প্রস্তাব করেছে সংস্থাটি। অনুমোদন পেলে চলতি বছরই কাজ শুরু করতে চায় তারা।
প্রান্তিক পেশাজীবীর জীবনমান উন্নয়ন (দ্বিতীয় পর্যায়) শীর্ষক একটি প্রকল্পের প্রস্তাব করা হয়েছে পরিকল্পনা কমিশনে। এটি বাস্তবায়নে ব্যয় হবে ৪৯ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। অনুমোদন পেলে দেশের সব জেলার ১৫১টি শহর বা উপজেলায় এটি বাস্তবায়ন করবে সমাজসেবা অধিদপ্তর। প্রকল্পের আওতায় কামার, কুমার, নাপিতসহ বিভিন্ন প্রান্তিক পেশার মানুষদের প্রশিক্ষণ ও সুদবিহীন ঋণ দেওয়া হবে।
নলকূপ স্থাপনের মাধ্যমে রাঙামাটি পার্বত্য জেলা এলাকায় নিরাপদ পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন ব্যবস্থার উন্নয়ন শীর্ষক একটি প্রকল্প প্রস্তাব করেছে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এজন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৭ কোটি টাকা। এ ছাড়া পর্যটন এলাকা সাজেকে নিরাপদ পানি সরবরাহ ব্যবস্থার জন্যও একটি প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়েছে।
খুলনা বিভাগের পাঁচ জেলার দুস্থ অসহায় হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন শীর্ষক একটি প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৮ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। সারা দেশে শিশু, কিশোর-কিশোরী ও নারী উন্নয়নে সচেতনতামূলক প্রচার কার্যক্রম শীর্ষক একটি প্রকল্প প্রস্তাব করেছে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়। এজন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৯ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। জেলেদের জীবনমান উন্নয়ন শীর্ষক একটি প্রকল্প প্রস্তাব করেছে মৎস্য অধিদপ্তর। এজন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৪২ কোটি ৪৫ লাখ টাকা।
এদিকে প্রকল্প প্রস্তাব এবং অনুমোদনের পাশাপাশি এডিপিতে বরাদ্দও গুরুত্ব পাচ্ছে। সম্প্রতি আটটি সরকারি পরিবারের ২৫ শয্যাবিশিষ্ট শান্তি নিবাস স্থাপন প্রকল্পে অতিরিক্ত ১৪ কোটি টাকা বরাদ্দ অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া আরও বেশ কিছু প্রকল্পে এডিপিতে থোক হিসেবে থাকা অর্থ থেকে বরাদ্দ চাওয়া হচ্ছে।
এগুলো সবই নতুন প্রকল্প হওয়ায় সচেতন থাকার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, নির্বাচন সামনে রেখে প্রকল্প নিলেও সমস্যা নেই, যদি মানুষের উপকার হয়। তবে এমন ছোট ছোট প্রকল্প ভবিষ্যতে এডিপিতে বাড়তি চাপ সৃষ্টি করবে কি না, সেটি চিন্তা করে অনুমোদন দেওয়ার পরামর্শ তাদের।
বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন কালবেলাকে বলেন, প্রকল্পগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা হলে নির্বাচনের জন্য প্রকল্প বেশি এলেও সমস্যা নেই। স্থানীয় পর্যায়ে এগুলোর উপকারিতা কী, সেটি দেখা দরকার। উপকারিতা থাকলে নির্বাচনের কারণে হলেও সমস্যা নেই। এখন যে প্রকল্প প্রস্তাবগুলো আসছে, সেগুলো তো এডিপিতে নেই। সুতরাং এগুলো অনুমোদন দিলে বাজেটের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে কি না, সেটি দেখা দরকার।