জাতীয়

বাংলাদেশ হঠাৎ কেন ৩৫ হাজার কোটি টাকা খরচ করছে

ফরাসি প্রেসিডেন্টের সফরের সময় উড়োজাহাজ ক্রয় চুক্তিতে সাক্ষর করেছে বাংলাদেশ। হাসিনা-ম্যাখোঁ যে চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছেন তা বাংলাদেশের জন্য প্রয়োজন ছিল না, এমনকি এর ব্যয়ভার বহন করার সক্ষমতা এ মুহূর্তে বাংলাদেশের নেই। বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, আগামী নির্বাচনের আগে ফ্রান্সকে খুশি করতেই এই উড়োজাহাজ ক্রয় চুক্তি স্বাক্ষর করেছে সরকার।গত ১০-১১ সেপ্টেম্বর ইমানুয়েল ম্যাখোঁর বাংলাদেশ সফরকে খুব গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার করা হয়েছে। তার হাসি, হ্যান্ডশেক এবং সাংস্কৃতিক অবগাহনকে ফুটিয়ে তোলার জন্য সেগুলোকে সতর্কতার সঙ্গে কোরিওগ্রাফি করা হয়েছিল। আর এসব কিছুর পিছনে ছিল একটি গভীর অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক এজেন্ডা। সেই এজেন্ডায় প্রকৃতপক্ষে কারা উপকৃত হবেন, তা যাচাই করার দাবি রাখে।

দুই দিনের বাংলাদেশ সফরের সময় ম্যাখোঁ একজন সম্মানিত পরিদর্শনকারী ব্যক্তিত্বের ভূমিকা পালন করেন। তিনি দাঁড়িয়ে লোকসংগীত শুনেছেন, পুরান ঢাকার রাস্তায় রিকশায় চড়েছেন এবং নানা ব্যঞ্জনের বাংলা খাবারের স্বাদ নিয়েছেন। এতকিছুর পরেও ম্যাখোঁ তার মোহনীয় ঐতিহাসিক সফরকে সম্পূর্ণরূপে ছদ্মবেশে ঢাকতে পারেননি। তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিমান সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের কাছে ৩৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি মূল্যে ১০টি এয়ারবাস উড়োজাহাজ বিক্রির চুক্তি করেছেন। এই উড়োজাহাজ ক্রয় বাংলাদেশের জন্য সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় এবং বাংলাদেশকে বছরের পর বছর এর ভার বহন করতে হবে।

চীনের প্রভাববলয়ে থাকা অঞ্চলগুলোতে ‘তৃতীয় পথ’ খুঁজছে পশ্চিমা অনেক দেশ। আর এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই ম্যাখোঁ তার সফর সাজিয়েছেন। বাংলাদেশে তার প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকার জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দুর্বলতাকে পুঁজি করা। অনেকেই বিশ্বাস করেন, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় থাকা নিশ্চিত করতে নির্বাচনে কারচুপির আশ্রয় নিতে পারে। আর এই পরিস্থিতিকে পুঁজি করে, ম্যাখোঁ বাংলাদেশে নির্বাচনের আগে ফরাসি বিমানশিল্পের পক্ষে একটি লাভজনক চুক্তি স্বাক্ষর করাতে সক্ষম হন।

বাংলাদেশ-ফ্রান্স এমন একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছেন যার বোঝা বহন করার সক্ষমতা বাংলাদেশের নেই। বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন নানামুখী সংকট মোকাবিলা করছে। রিজার্ভ সংকট, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, খেলাপি ঋণের বৃদ্ধি, সরকারের বিপুল ঋণ ইত্যাদি সমস্যার মধ্যে আলোচ্য চুক্তি বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর। এ চুক্তিটি এমন এক সময়ে স্বাক্ষরিত হলো যখন বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে কঠোর অবস্থানে যুক্তরাষ্ট্র। একটি স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন করতে এবং নির্বাচনে জোরপূর্বক প্রভাব বিস্তার ঠেকাতে বাংলাদেশের জন্য স্বতন্ত্র ভিসানীতি ঘোষণা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের এই অবস্থানের বিরুদ্ধে পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে ফ্রান্সের সঙ্গে উড়োজাহাজ ক্রয় চুক্তি করেছে বাংলাদেশ সরকার। এটি ইউরোপের সমর্থন আদায়ে সরকারের প্রাথমিক উদ্দেশ্য বলে মনে হচ্ছে।

উড়োজাহাজ নয় যেন উড়ন্ত সাদা হাতি:

এভিয়েশন শিল্পের উত্থানের মধ্যেও পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিমান সংস্থা। দুর্বল পরিকল্পনা, যোগ্য পাইলটের অভাব, দক্ষ কেবিন ক্রুর ঘাটতি এবং বর্ধিত অপারেশনাল অব্যবস্থাপনার মতো নানা সমস্যায় জর্জরিত বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্স এবং থাই এয়ারলাইন্সের একটি বিমান যথাক্রমে দৈনিক ১০ দশমিক ২ ঘণ্টা এবং ১২ ঘন্টা ব্যবহারের বিপরীতে বিমান বাংলাদেশের বহরে থাকা উড়োজাহাজ গড়ে আনুমানিক দৈনিক ব্যবহার হয় মাত্র পাঁচ ঘণ্টা । যদিও ওয়াইড-বডি বোয়িং উড়োজাহাজগুলো দৈনিক ১৩-১৬ ঘণ্টা কাজ করতে পারে, তবে ২০১৩ সালের জুনে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের এই ধরনের বিমান গড়ে প্রতিদিন ১০-১৩ ঘণ্টার মধ্যে ব্যবহার সীমাবদ্ধ ছিল।

মূলত পাইলটের ঘাটতি এবং সময়সূচি সংক্রান্ত সমস্যার কারণেই এই অপচয় হয়েছে। গত এক দশকে বাংলাদেশ বিমান তার বহরকে দ্বিগুণ করেছে। বর্তমানে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের কাছে রয়েছে ২১টি বিমান। ২০০০ সালে যেখানে ২৮টি আন্তর্জাতিক রুটে বিমান বাংলাদেশের ফ্লাইট যাতায়াত করত সেখানে বর্তমানে তা নেমে দাঁড়িয়েছে ২১টিতে। লাভজনকতাও হারিয়েছে তারা। আর এই সংকট তৈরি হয়েছে অপারেশনাল ঘাটতির কারণে। এই সংকটের মধ্যেও বিমান বাংলাদেশের নতুন বিমান কেনার সিদ্ধান্তের অন্তর্নিহিত ব্যবসায়িক যুক্তি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা। দ্বিতীয়ত, বৈদেশিক মুদ্রা সংকটের কারণে রাজস্ব ফেরত দিতে না পারায় সম্প্রতি বাংলাদেশে রুট স্থগিত করেছে অনেক আন্তর্জাতিক এয়ারলাইন্স।

এতে বাংলাদেশ বিমান এয়ারলাইন্সের বিমানের ব্যবহার বেড়েছে। তবুও বাংলাদেশ বিমান একটি লোকসানি প্রতিষ্ঠান হিসেবে রয়ে গেছে।২০২১ এবং ২০২২ সালে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স প্রায় ৪১ মিলিয়ন ডলার এবং ৫৪ মিলিয়ন ডলার মুনাফা অর্জনের দাবি করেছে। অথচ ২০২২ সালের নভেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ সিভিল এভিয়েশন অথরিটি এবং রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন পদ্মা অয়েলের কাছে বিমানের প্রায় ১ বিলিয়ন ডলারের বিল বকেয়া রয়েছে, যার কোনো হিসাব সেখানে ছিল না। এই অপরিশোধিত বিলগুলো হিসাব করলে বিমান বাংলাদেশ লাভের পরিবর্তে ব্যাপক লোকসানে রয়েছে।

তৃতীয়ত, বিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন তুলেছেন এয়ারবাস কেনার সিদ্ধান্ত নিয়ে। কারণ বাংলাদেশের বহরে থাকা বেশিরভাগ বিমানই বোয়িং কোম্পানির। নতুন আরেকটি কোম্পানির বিমান চালানোর মতো যথেষ্ট প্রশিক্ষিত এবং অভিজ্ঞ পাইলট বাংলাদেশের নেই। প্রশিক্ষিত রক্ষণাবেক্ষণ কর্মীর অভাব রয়েছে। পাইলট এবং কেবিন ক্রুদের জন্য নতুন টাইপ-রেটিং সার্টিফিকেশন প্রয়োজন হবে, যা অনেক ব্যয়বহুল। সবচেয়ে হাস্যকর বিষয় হলো, এয়ারবাস থেকে দুটি ডেডিকেটেড কার্গো বিমান কেনার সিদ্ধান্ত। এয়ার অপারেটর সার্টিফিকেট (এওসি) অডিট রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২২ সালে বিমান বাংলাদেশের ৪,৯৮,০০০ টন কার্গো পরিবহনের ক্ষমতা ছিল। যেখানে পরিবহন করা হয়েছে মাত্র ২৮,০০০ টন পণ্য, যা মোট ক্ষমতার মাত্র ৬ শতাংশ। ডেডিকেটেড পণ্যবাহী উড়োজাহাজ কেন অপচয় সে বিষয়ে বাংলাদেশের ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টারে প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে বিশেষজ্ঞরা তিনটি কারণ উল্লেখ করেছেন।

প্রথমত, বাংলাদেশে এয়ার কার্গোর চাহিদা অনেকটা মৌসুমী। বছরে মাত্র ৫-৬ মাস এয়ার কার্গোর চাহিদা থাকে। সুতরাং, অফ-সিজনে উড়োজাহাজগুলো অলস বসে থাকতে হবে। দ্বিতীয়ত, ৫-৬ মাস বাংলাদেশ বা এশিয়া থেকে ইউরোপ/উত্তর আমেরিকা অভিমুখে পণ্য যাবে, কিন্তু আসার সময় তাদের ফিরতে হবে খালি। সুতরাং এটা কোনোভাবেই লাভজনক হবে না। ২০২৩ সালের প্রথম ৯ মাসে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ১৯ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। বাংলাদেশি মুদ্রার অবমূল্যায়ন ঘটেছে, ডলার সংকটে জ্বালানি, সার এবং মৌলিক পণ্য আমদানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ অবস্থায়ও অপ্রয়োজনীয় বিমান ক্রয় দেশের জন্য ক্ষতিকর একটি সিদ্ধান্ত। সুতরাং ১০টি এয়ারবাস কেনার সিদ্ধান্ত কোনো প্রকার বাণিজ্যিক প্রয়োজনের পরিবর্তে রাজনৈতিক সুবিধার দ্বারাই অনুপ্রাণিত বলে মনে করা যেতে পারে।

মূল্যায়নের আগেই ক্রয়ের সিদ্ধান্ত:

কোনো টেন্ডার ছাড়াই এবং প্রযুক্তি ও আর্থিক মূল্যায়ন না করেই এয়ারবাস থেকে ১০টি উড়োজাহাজ কেনার চুক্তি স্বাক্ষর করেছে সরকার। ডেইলি স্টার বেশকিছু ঘটনার কথা জানিয়েছে: ৩ মে ২০১৩ তারিখে বিমানের পরিচালনা বোর্ড উড়োজাহাজের প্রয়োজনীয়তা অনুসারে ‘‘আটটি পর্যন্ত রোলস-রয়েস চালিত A350-900/1000 বিমান (‘A350 প্যাক্স এয়ারক্রাফ্ট’) বা ‘অন্য যে কোনো উপযুক্ত বিমা’ (প্রশস্ত বা সরু) ক্রয় করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’’

দুই দিনের মধ্যে ৫ মে ২০২৩ তারিখে, প্রধানমন্ত্রী শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা যুক্তরাজ্যের ব্যবসা ও বাণিজ্যবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী লর্ড ডমিনিক জনসনের সঙ্গে একটি যৌথ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তি অনুসারে ‘বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স এয়ারবাস কোম্পানি থেকে 8টি রোলস-রয়েস চালিত A350-900/1000 বিমান এবং পণ্যবাহী দুটি এয়ারবাস (আরও আলোচনা সাপেক্ষে) ক্রয় করা হয়েছে।

ডেইলি স্টার বিমানের অভ্যন্তরীণ ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার নিয়েছে। যারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, বাংলাদেশ যখন এয়ারবাস কেনার ঘোষণা দেয় তখন মূল্যায়ন কমিটি মাত্র কয়েকটি নিষ্পত্তিহীন সভা করেছে এবং বিমান ‘রাষ্ট্রের কাছে কোনো প্রতিবেদন পেশ করার ধারেকাছেও ছিল না।’ ঘটনার প্রকৃতি এবং ক্রমানুযায়ী এই ইঙ্গিত দেয় যে, সরকার পরিবর্তন হলে চুক্তিটি আইনি পর্যালোচনার মুখে পড়বে।

আরও খবর

Sponsered content