21 December 2024 , 4:57:27 প্রিন্ট সংস্করণ
বেলা ১১টা। শিক্ষক ইয়াসমিন ঘরের কাজে ব্যস্ত। তার উঠোনের এক পাশে দু’চালা টিনের ঘরের বেড়ায় ঝুলছে উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাইনবোর্ড। বিদ্যালয়ের ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখা গেল কোন শিক্ষার্থী নেই, মেঝে জুড়ে আলগা বালুর ছড়াছড়ি, সেই বালুর উপর মোটরসাইকেলের ছাপ স্পষ্ট। এক কোণে শিক্ষার্থীদের বসার মাদুরগুলো পড়ে আছে। এসব নিয়ে প্রশ্ন করতেই শিক্ষক ইয়াসমিনের মুখ কাচুমাচু। বললেন, ‘রোজ ১২টায় ছুটি হয়, আজ একটু আগে ছেড়ে দিয়েছি। সরকিছু ঠিকঠাকই চলছে।’ সম্প্রতি কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার কচুবাড়িয়া পুকুরপাড়া উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে এমন দৃশ্য চোখে পড়ে। শুধু এই বিদ্যালয় নয়, কুষ্টিয়ার ৫ উপজেলায় সরকারের আউট অব স্কুল চিল্ড্রেন এডুকেশন প্রকল্পের আওতায় বেসরকারী সংস্থা (এনজিও) দ্বারা পরিচালিত অধিকাংশ বিদ্যালয়ের একই অবস্থা। এসব বিদ্যালয়ের বিভিন্ন খাতে বরাদ্দের বেশিরভাগ অর্থ লোপাট হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
আনুষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে থাকা শিশুদের অক্ষর জ্ঞান সম্পন্ন করতে সরকার আউট অব স্কুল চিল্ড্রেন এডুকেশন প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু হয় প্রায় তিন বছর আগে।
প্রকল্পের আওতায় কুষ্টিয়া সদরসহ ৫ উপজেলায় ৩৪৪টি বিদ্যালয়ে পাঠদান কার্যক্রম শুরু হয় ২০২২ সালের ১ জানুয়ারী থেকে। এ কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব পায় জাগরনী চক্র ফাউন্ডেশন নামের একটি বেসরকারী সংস্থা। পরে এই সংস্থা নিজেদের ভাগে তিনটি রেখে বাকি দুটি উপজেলার কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব দেয় প্রভাতী পল্লী উন্নয়ন ও ঊষা বাংলাদেশ নামের দুটি সংস্থাকে। তবে সরকারের এ মহতি উদ্যোগ অনেকটা ভেস্তে গেছে বেসরকারী এই সংস্থাগুলোর দুর্নীতির কারণে। অভিযোগ উঠেছে বিদ্যালয়গুলোর জন্য বরাদ্দের একটি বড় অংশ লোপাট করেছে সংস্থার লোকজন। বর্তমানে অধিকাংশ বিদ্যালয় পাঁচ থেকে সাতজনের বেশি শিক্ষার্থী নেই। কিছু কিছু স্কুলে পাঠদানও হয় না ঠিকমত।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, কাগজে কলমে প্রতি বিদ্যালয়ে ৩০ জন করে শিক্ষার্থী থাকলে বাস্তবে ৬-৭ জনের বেশি শিক্ষার্থী নেই। অথচ খাতা কলম উপবৃত্তি পোশাকসহ নানা খাত থেকে ৩০ জনের জন্য বরাদ্দের অর্থই তুলে নিয়েছেন এনজিও কর্মকর্তারা। মিরপুর উপজেলার অঞ্জণগাছী উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায় মাত্র ৬ জন শিক্ষার্থী পাঠ গ্রহণ করছে। শিক্ষক ফারজানা আক্তারের দাবি আগে তার বিদ্যালয়ে ৩০ জন শিক্ষার্থী ছিল। বর্তমানে ৬ জন আছে, বাকিরা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। তবে ওই শিক্ষার্থীরা তার বিদ্যালয় ছেড়ে কোন বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে সে তথ্য দিতে পারেননি ফারজানা।
এদিকে, একই উপজেলার আমলা খামারপাড়া উপানুষ্ঠানিক বিদ্যালয়ের কোন অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যায়নি। অনুসন্ধানে দেখা যায়, ওই বিদ্যালয়ের সাইনবোর্ড শিক্ষক কামিনী খাতুনের নিজ বাড়ির দেওয়ালে ঝোলানো রয়েছে। শিক্ষক কামিনী জানান, তার বিদ্যালয়ে মাত্র ৪ জন শিক্ষার্থী আছে। তাদের তিনি বাড়ির ড্রইং রুমে পাঠদান করেন। তবে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে তার বাড়ি গিয়ে সেই ৪ জন শিক্ষার্থীকেও পাওয়া যায়নি। শিক্ষকের দাবি তিনি তাদের সকালের বদলে বিকেলে পাঠদান করেন।
জানা গেছে, প্রতিটি বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক ছাড়া আর কোন জনবল নেই। তবে বিদ্যালয় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার অজুহাতে পরিচালনাকারী এনজিও প্রতিটি বিদ্যালয়ে কথিত আয়ার পদ সৃষ্টি করে প্রতিমাসে ৫০০ টাকা করে তুলে নিয়েছে। এছাড়া বিদ্যালয়ের পরিছন্নতা রক্ষার জন্য বরাদ্দকৃত উপকরণের টাকাও তারা আত্মসাৎ করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
প্রতিটি বিদ্যালয়ের নির্দিষ্ট সময়ে অভিভাবক সভা ও সিএমসি সভা করার নিয়ম থাকলেও অধিকাংশ বিদ্যালয় এসব সভা হয়নি। তবে এই খাতে বরাদ্দের সব টাকায় সংশ্লিষ্ট তিনটি এনজিও কর্তৃপক্ষ ভাগ বাটোয়ারা করে নিয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে।
শিক্ষার্থীদের প্রতি বছর দুই সেট করে স্কুল ড্রেস দেওয়ার কথা থাকলেও তিন বছরে তাদের মাত্র দুবার ড্রেস দেওয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়। এছাড়া এসব ড্রেস অত্যন্ত নিম্নমানের কাপড় দিয়ে তৈরি বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
প্রতিটি বিদ্যালয়ে উন্নতমানের দুটি করে বৈদ্যুতিক বাল্ব ও একটি করে ফ্যান বরাদ্দ থাকলেও কোন বিদ্যালয়েই ফ্যান চোখে পড়েনি। এছাড়া দুটি বাল্বের বদলে নিম্নমানের একটি করে বৈদ্যুতিক বাল্ব সরবরাহ করা হয়েছে। এছাড়া জাতীয় দিবস পালন, পরিবহন বিল, জরিপ কাজের বিল, ক্যাম্পেইন কমিটির বিল, বিষয় ভিত্তিক খাতা, ড্রইং পেপার, রং পেন্সিলসহ অন্যান্য খাতে বরাদ্দের টাকা বেশির ভাগটাই লুটপাট হয়ে গেছে।
তবে এনজিও কর্মকর্তারা অর্থ লোপাটের অভিযোগ অস্বীকার করে জানান, তারা যে খাতে যেমন বরাদ্দ পেয়েছেন সেভাবেই খরচ করেছেন।
জাগরণী চক্র ফাউন্ডেশনের সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার আশরাফুল ইসলাম বলেন, তারা যতটা স্বচ্ছতার সাথে প্রকল্পটির কাজ বাস্তবায়ন করেছেন তা সারা বাংলাদেশ খুঁজলেও পাওয়া যাবে না। তার দাবি বেশ কিছু শিক্ষার্থী ইতিমধ্যে তাদের বিদ্যালয় ছেড়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। এ কারণে তাদের বিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা কমে গেছে। তিনি বলেন, এটি প্রকল্পের নীতিমালা অনুযায়ী করা হচ্ছে।
জানতে চাইলে কুষ্টিয়া উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর সহকারী পরিচালক জিহাদুল ইসলাম জিহাদ বলেন, তার জানামতে কুষ্টিয়ায় এ প্রকল্পের কাজ সুষ্ঠু ও সুন্দর রূপে পরিচালিত হচ্ছে। তবে প্রকল্পে কোন দুর্নীতি হলে তার দায় সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে নিতে হবে। অভিযোগ খতিয়ে দেখা ব্যবস্থা নেয়া হবে।